অনুবাদ সাক্ষাৎকার     «Magazine»   «Home»   «Map&Rev»

 

উর্দুর বিখ্যাত বাংলাদেশি সাহিত্যিক জয়নুল আবেদীনের কথা

প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানেই ১৯৩৬ সাল। আর বাংলাদেশের বিখ্যাত ছোটগল্পকার জয়নুল আবেদীনের জন্মও সেই সালে। বলা যেতে পারে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর জয়নুল আবেদীনের বেড়ে ওঠা একসাথে।

জয়নুল আবেদীনের জন্ম এলাহাবাদে। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ঢাকায় চলে যান। ওখানে স্নাতকোত্তর শেষ করে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। সে সময় তিনি বাংলাদেশ টাইমসে জ্যেষ্ঠ নিজস্ব সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন। এখন তিনি পাকিস্তানের বহুল-প্রচারিত একটি দৈনিক পত্রিকার [বাংলাদেশ] সংবাদদাতা। কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত সফরে করাচি এলে তাঁর সাথে দেখা। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম: আপনার গল্পে রাজনীতির জোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়; এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?

জয়নুল আবেদীনের জবাব ছিল: আমি রাজনীতিতেও ছিলাম। আমার মনে হয় রাজনীতি সামগ্রিক অর্থনীতির একটি প্রকাশের নাম। কেউ শ্রমিক সংঘের অধিকার নিয়ে কথা বললে সেটাও তার রাজনীতি। আমার গল্পের রং রাজনৈতিক হলেও আমি প্রেমের মহোত্তম আবেগকে মমতা দিয়ে সত্যের সাথে তুলে ধরি। যদি আমার গল্পের নায়িকা কারও প্রেমে পড়ে তাহলে সেটার কথাও বাস্তবের সাথে মিল রেখেই বলি। আমার ধারণা যে গল্পকার বা শিল্পীকে সত্যের কাছাকাছি থাকতে হয়, জীবনের কাছাকাছি থাকতে হয়। সর্বসাধারণের থেকে দূরে গিয়ে এ কাজ হয় না; যারা এমনটি করে, তাদের মৃত্যুর সাথে তাদের কাজেরও মৃত্যু হয়।

জয়নুল আবেদীন সেসব প্রগতিশীল গল্পকারদের সমপর্যায়ের যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নাম করেছেন। উনি বলেছেন: প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে আমার সম্পর্ক আছে কারণ ঢাকায় আসার পর আমি সত্যিকার অর্থে জীবনকে দেখি। এ কারণেই আমার মনে হয় যে বাস্তবতার ওপর ভর করে চলা প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের গল্পেও জীবনের সঠিক প্রতিফলন ঘটায়। আমিও তাই করি। জীবন প্রগতির পথে থাকলে, আমার কলমও প্রগতির পথে থাকে। নিঃসন্দেহে আমি প্রগতিশীলতার পক্ষে আর মৌলবাদী চরমপন্থার বিপক্ষে। আমি বাঁধাধরা চৌহদ্দির মধ্যে থাকি না। আমি মনে করি গল্পের মাঝে গল্প থাকাটা জরুরি।

আপনি কি এখনও মনে করেন যে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা আছে যদিও আন্দোলনটি এখন আর সক্রিয় নেই? এ প্রশ্নের উত্তরে জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন: আজও লোকে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা বলে এবং সে মোতাবেক সাহিত্যকর্ম করে যায়। এঁদের পাঠকসংখ্যাও কিছু কম নয়। সম্পর্কটা থেকেই যাচ্ছে। এ থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখনও চলছে? যদি আন্দোলনটা না থাকত তাহলে লোকে এখন তার নাম নিত না। আসল কথা হল সে-সময়ের কোনও ভিত্তিই এখন আর ভিত্তি হিসেবে নেই। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে আর শিল্পীর কাজে তা প্রকাশ পাচ্ছে এবং পাবে। এভাবে চিন্তা করলে প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আজও জীবিত। নিশ্চিতভাবে এখন অবস্থা অন্য রকম; তখন আরেক রকম ছিল। আগে সংগঠিত হয়ে কাজ করত, এখন লোকে সংগঠনের বাইরে থেকে লিখছে।

জয়নুল আবেদীন রূপকার্থক গল্পও লিখেছেন। রূপকের ব্যবহার আর আধুনিকতা নিয়ে একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন ছিল: আধুনিকতা কি? কিন্তু আজ তারা কোথায়? প্রত্যেকে নিজের মত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। আমাদেরও সে অভিজ্ঞতা হয়েছে। যোগাযোগের সমস্যা হয়েছে। আমাদের পাঠক আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে। আজও লোকে সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণচন্দর আর রাজিন্দর সিং বেদীর লেখা পড়তে চায়। কিন্তু আধুনিক লেখকদের মাঝে এমন কয়জন আছে যাদের লেখা লোকে পড়তে চায়? আধুনিকেরা সুরিয়ালিজম এবং এক্সপ্রেশনিজম সামনে রেখেছে। এগুলো অঙ্কণশিল্পের বিষয়; আবার এগুলোর সৃষ্টিকর্তা পিকাসো নিজেই তা বাতিল করে দিয়েছে। আমি কিছু রূপক গল্প লিখেছি। যখন আমি কোনও কথা বলতে পারি না, তখন তা রূপক বা উদাহরণের মাধ্যমে বলে ফেলি। পাঠকদের সাথে রূপকেই যোগাযোগ হয় কারণ আমি যে রূপক তুলে ধরি সেগুলো নিজের জগৎ থেকেই নেওয়া। পাঠককে বোঝাতে আমার কোনও সমস্যা হয় না। যা বলতে চাই সোজাসুজি বলে দিই কারণ আমার গল্পের ভাষা সাধারণ।

জয়নুল আবেদীনের গল্পের সাধারণ পারিপার্শ্বিকতা বাংলাদেশ এবং সেখানকার জীবন। সুনিপুণ বর্ণনায় সে সব গল্প লেখেন তিনি। গল্পের শেষে কোনও চমক থাকে না কিন্তু অনেক সুন্দর এবং ভাবনা-উদ্রেককারী বাক্য থাকে। এর কারণ সম্ভবত এই যে জয়নুল আবেদীন পেশার খাতিরে একজন অভিজ্ঞ গল্প-বলিয়ে সাংবাদিক। তার বক্তব্য: সাংবাদিকতা আর সাহিত্য দুটি আলাদা বস্তু; কিন্তু সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে সাহিত্যের উন্নতি ঘটিয়েছে। আমি সাংবাদিকতার কারণে জীবনকে কাছ থেকে জেনেছি।

তাঁর কাজে প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে ভাষা আর সাদামাটা পরিবেশের অনায়াস প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তারই একটি ধারণা পাওয়া যাবে ছাপা-হবে এমন একটা গল্প ‘টোকাই’-এর শুরুর বাক্যগুলি পড়লে:

ফুটপাথে খেলতে থাকা বাচ্চার দল চিৎকার করতে করতে ভাই-ভাই হোটেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় আব্দুল ঝট করে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল: শালার আছে তো হাত ভরে, তারপরও গেছে সরকারের গদি উলটাতে।

তারপর আব্দুল পানি-ভরা কেতলি চুলার ওপর বসিয়ে সারা রাতের বাসি থালা-বাসন আর পেয়ালা ধুতে বসল।

‘যাকেই দেখি চিৎকার করছে। না আল্লাহর ভয়, না সামরিক আইনের। একটা গুলি চললে কারুর হদিশও পাওয়া যাবে না; মায়েদের শাড়ির আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকবে।’ আব্দুল মাছির মত ভনভন করতে করতে এত জোরে থালা মাজার চেষ্টা করল যে থালাটা পড়ে ভেঙ্গে গেল। আব্দুলের বিড়বিড়ানি থেমে গেল; কেউ যেন হঠাৎ তার পেটে জোরে লাথি মেরেছে; তার দম বন্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরে হুঁস ফিরলে ভাঙ্গা থালাবাসন উঠিয়ে ময়লার টিনে এমনভাবে রাখল যেন নিজের বৃদ্ধকাল তুলে রাখছে।

গার্সিয়া বলেছিলেন: সাহিত্য রচনার কাজটা কাঠের কাজের মতই। লেখার কাজ ততটাই কঠিন ঠিক যতটা কঠিন টেবিল বানানো। দুটোর ক্ষেত্রেই আপনি বাস্তবতা নিয়ে কাজ করছেন যা কাঠের মতই শক্ত। জয়নুল আবেদীনের মত অবশ্য আলাদা। তাঁর বক্তব্য যে সাহিত্যিক আর ছুতার আলাদা আলাদা লোক। সাহিত্যে আবেগ আর অনুভূতি সামনে আসে। কাঠের কাজে কাঠই বাস্তবতা। সাহিত্যিকের জন্য বাস্তবতা হল সমস্যা। এ কারণে দুটি কাজ পুরোপুরি ভিন্ন। আমার ধারণা যে আমার সামনে আমার সমস্যা আছে, জীবন আছে। কাঠ তো কাঠই। যদি লেখার বা জীবনের কোনও উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে লেখার কোনও মূল্য নেই। সমালোচকদের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন: আমি এই ঝামেলায় পড়তে চাই না। আমি লিখি। সমালোচকরা যা মনে করে, বলেন। ওসবে কান দিই না।

বাংলাদেশে উর্দু সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রশ্নের জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন: বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে সেখানকার লেখকদের একটা বড় অংশ পাকিস্তানে চলে এসেছেন; যেমন উম্মে আমারা, বানু আখতার শহুদ, সালাহউদ্দীন মুহম্মদ, নজীর সিদ্দিকী, জকী সিদ্দিকী, আনিস সিদ্দিক, শাহজাদ মনজার, মেহমুদ ওয়াজেদ, আলী হায়দার মালিক, ডাক্টার হানিফ ফৌক, নূরুল হুদা সৈয়দ, আহমদ জয়নুদ্দীন, শাহজাদ আখতার এবং আদীব সোহেল প্রমুখ।

এখন ওখানে আছেন কয়েকজন অর্থাৎ আমি, আহসান আহমেদ আশ্‌ক, নওশাদ নূরী, আতাউর রহমান জামিল, আহমদ ইলিয়াস, সীন মীম সাজিদ, আইয়ুব জওহর, এম, নঈম, কলিম আহমেদ, গুলাম মুহম্মদ, হাফিজ দেহলভী, আখতার আনলভী, আহমদ সাদি, ডাক্তার কলিম সহসরামী, ডক্টর নূরুদ্দীন, প্রফেসর শামস শায়দাঈ, শামীম জামানভী, শাম বারিকপুরি, প্রফেসর ইউসুফ হাসান আর শোয়েব আজিম প্রমুখ।

ওখানে উর্দুতে কিছু ছেপে বের হয়। তবে লোকেরা নিজের টাকা খরচ করে তা প্রকাশ করে। যেমন ইন্তেখাব, কলমকার, ইনকিশাফ আর আল-আখবার। এগুলোতে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক লেখাপত্র ছাপা হয়। তারপরও সে বই এবং ছাপাইয়ের কাজ পাকিস্তানে যে মানের হয় তার মত নয়। এর প্রধান কারণ হল লেখক আর প্রকাশনার সাথে জড়িত লোকজন পাকিস্তানে চলে এসেছে। অপরদিকে বাংলার ছাপার মান ভাল। বাংলায় কম্পোজ করা যায় আর উর্দুতে হাতে লিখতে হয়। তবে উর্দুতে নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। ডাইজেস্টের প্রচলনও নেই।

বাংলাদেশের উর্দু সম্পর্কে জয়নুল আবেদীন আরও বলেন যে ওখানে উর্দু পত্রপত্রিকা আর বই ছাপানো এতটা সহজ নয়। আমি নিজে চতুর্থ শতকের সময় নিয়ে গল্প লিখছি কিন্তু বই আর প্রকাশনার মান ভাল না হওয়ার কারণে আজ পর্যন্ত বই ছেপে উঠতে পারিনি; কিন্তু লিখে চলেছি। আদতে আমি এবং আমার মত আরও কিছু লেখক লেখাকে আমাদের নিয়তি বানিয়ে ফেলেছি। আমি লেখার মাধ্যমে জনগণের সমস্যা পাঠকের সামনে তুলে ধরি। এ কারণে সার্বিক অবস্থা অনুকূলে না হলেও লিখে যাই।

আপনিও আপনার অন্য সঙ্গীদের মত পাকিস্তানে চলে আসেননি কেন? বিয়েও করেননি; সংসারের দায়িত্বও ছিল না? এ প্রশ্নটা করলে জয়নুল আবেদীন গভীর শ্বাস নিয়ে বলেন: আমি ভেবেছিলাম যে একবার পূর্বপুরুষেরা পাকিস্তান হবার পর ভিটে ছেড়েছে; দ্বিতীয়বার এ কাজটা করবার সাহস আমার ছিল না। আর আমি এটাকে ঘর ছেড়ে আসা হিসেবেও দেখছিলাম না।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে লেখা ছোটগল্পগুলোর সম্পর্কে জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন: আমাদের কথা হল যে আমরা ছোট এলাকার বাসিন্দা, আমাদের লেখা মোটামুটি একই ধরনের। লেখার চেহারা আর ধরনে অবশ্য পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু গল্প লেখার ক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, দু’জায়গার লেখকেরাই একটা কিছুর খোঁজে ব্যস্ত। এমন কিছু যা দেখে মনে হয় এঁরা সাহিত্যে বিরাট কিছু করে ফেলেছে। এটা ভাল কথা যে আমরা কিছু একটার খোঁজে ব্যস্ত। আসলে আমাদের সমস্যা কমবেশি একই ধরনের আর দুই জায়গায়ই এর প্রকাশে মিল পাওয়া যায়।

উর্দু ভাষার ব্যাপারে ওখানে অবশ্যই বড় একটা পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা শিখছে। ভারতের মত ওখানেও উর্দু জানা অনেকে আছে যাদের সন্তান-সন্ততি উর্দু জানে না। যেমন আহমদ ইলিয়াস উর্দুর বড় একজন কবি, কিন্তু তাঁর মেয়েরা বাংলায় কবিতা লেখে। আরেক কবি নওশাদ নূরীর মেয়ে সবসময় বাংলায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পায়। এখনও সচেতন বাঙালি সাহিত্যিক এবং কবিরা পরামর্শ দেয় নিজের ভাষার উন্নতির জন্য কিছু করতে। কিন্তু আমরা নিজেরাই ভীত ছিলাম আর সে ভয়টা এখনও রয়ে গেছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। বাধা যা ছিল তা দূর হয়ে গেছে। কিন্তু জানি না উর্দু ভাষার সাহিত্যিক ও কবিরা ওদিকে কেন মনোযোগ দেয় না।

বাংলাদেশে মুশায়েরা বা কবিতাপাঠের সভার রীতিও সীমিত চালে চলছে। পঞ্চাশ থেকে এক শ’জন বসে কবিতা পাঠ করে।

জয়নুল আবেদীন নিজের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে বলেন: আমার চাচা মুহম্মদ ওয়াজির খান লিখতেন। নাটকও করতেন। ওরকম নাটক আমাদের বাসাতেও হত। আমার বাবারও শিল্প-সংস্কৃতির দিকে ঝোঁক ছিল। সে কারণে আমার ভেতরও এই আবেগটা ছিল। আমি আসলে মুনশি প্রেমচাঁদের গল্প পড়ার পর লেখার দিকে ঝুঁকে পড়া সামলাতে গিয়েই প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। ঝোঁকটা বাড়তেই আদীব সোহেল, আরিফ আমান যাঁরা তখন লাহোরে থাকতেন আর নওয়াব মহিউদ্দীন (যিনি ফরহাদে তৈমুরী নামের ডাইজেস্টে লিখতেন) প্রমুখ আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।

আমি ১৯৬০ থেকে লেখা শুরু করেছি। তার আগে ছোট সাংবাদিক ছিলাম এবং ছোটখাট পত্রিকায় কাজ করতাম। আমার প্রথম গল্প ‘গুরুর’ (গর্ব) লাহোরের সাপ্তাহিক নুসরাতে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন হানিফ রামে। দ্বিতীয় গল্প ‘পিন্টো’ মির্জা আদীবের সম্পাদনায় আদবে লতীফে ছাপা হয়েছিল। সাথে সাথে আফকার এবং ফুনুঁতেও লেখা ছাপা হতে লাগল। তখন দেশে আধুনিকতার একটা ধারা বেড়ে উঠছিল। আমিও তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারিনি। আমি দু-তিনটে রূপক গল্পও লিখেছি যেখানে লোককাহিনিকে ভিত্তি করে গল্প তৈরি হয়েছে যেমন ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘জাগো রে’, ‘দর্দ আয়েগা’, ‘বে পাওঁ’ আর ‘জ্যাকি’, ইত্যাদি। পরে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের পর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছুদিন গল্প লেখা বন্ধ ছিল।

দ্বিতীয় বার ১৯৭৫ সালের পর আবার লেখা শুরু হয় । প্রথম গল্প ছিল ‘কাচ্চি সড়ক’ (কাঁচা রাস্তা)। এতে বাংলাদেশ যে রাস্তায় এগুচ্ছিল তারই নির্দেশনা ছিল। তারপর ‘কৃষ্ণচূড়া’ লিখি। কৃষ্ণচূড়া হল গুলমোহরের বাংলা নাম। আমার ধারণা যে তারপর আমি সঠিক অর্থে গল্প লেখা শুরু করি এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। গেল বার বছর ধরে দশ-বারটা গল্প লিখে । ছাপা হয়নি এমন গল্পের মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে একটি রূপক গল্প হল ‘আধে ঘর কী কহানী’ (অর্ধেক ঘরের গল্প)। এরকম দ্বিতীয় গল্পের নাম ‘ফির ক্যা হুয়া?’ (আবার কি হল?)। আগামী দু-তিন বছরে ওগুলোকে বই হিসেবে ছাপানোর ইচ্ছে রাখেন তিনি।

জয়নুল আবেদীন চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখেও নাম করেছেন। তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত উর্দু চলচ্চিত্র সঙ্গমের গান এবং সংলাপ লিখেছেন। তাছাড়া আরও কয়েকটি নাম-করা চলচ্চিত্র যেমন চকোরী, ছোটে সাহেব, আনাড়ী এবং পায়েলের গল্প লিখেছেন। তখন বাংলা চলচ্চিত্রে তার লেখা গল্পের মধ্যে আছে তওবা, গঙ্গা-যমুনা; কঠোর আর সংযোগ। এখন পর্যন্ত তিনি পনের-বিশটা চলচ্চিত্রের সংলাপ লিখেছেন।

খাঁটি সাহিত্য রচনার সাথে চলচ্চিত্রের গল্প কি করে লেখেন? কারণ দুটো বিপরীত ধরনের বিষয়।

‘চলচ্চিত্র এক ধরনের কলা আর মাধ্যম। যদি কেউ এটা জানে, তো সেই নিরীখেই লেখে। চলচ্চিত্রের একটি প্রধান বক্তব্য থাকে যেটাকে ঘিরে পুরো কাহিনি লিখতে হয়। জয়নুল আবেদীন বলেন: আমি চলচ্চিত্রের কাহিনি লেখবার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা সামনে রাখি। গল্পের একটি ভিত্তি থাকেট যেমন অবিনশ্বর প্রেম; এ রকম একটা অবস্থা দাঁড় করিয়ে দিই আর চলচ্চিত্র তৈরি হয়ে যায়; যেমনটি আমি চকোরীতে করেছি। সাদামাটা পরিবেশে লেখা হয়েছে। চলচ্চিত্রের গল্প লিখতে গিয়ে গাম্ভীর্যকে সরিয়ে রেখেছি; চটুল হয়ে চলচ্চিত্রের গল্প লিখেছি।

সাহিত্যিক হওয়ার কারণে আপনি নিজের লেখায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকের মাঝে সাহিত্য সচেতনতার জন্ম দিতেও পারতেন? তাদের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নিজেই কেন বাণিজ্যিকতায় চলে এলেন?

হ্যাঁ, আমি প্রথম দিকে সে চেষ্টা করতাম; আমি চলচ্চিত্রের গল্পে সচেতনতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সাহিত্যের ছোঁয়া আর পরিবেশ দিতে লাগলাম। তখন প্রযোজক আপত্তি তুললেন কারণ পয়সা প্রযোজকের; তাই তার মতামত ফেলে দেওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে আমি সংলাপের রং পালটে দিতাম। স্বাভাবিকভাবেই সেভাবে সংলাপ লিখতাম যেমনটি করেছিলাম চকোরীর এই সংলাপে:

শাবানা… কি ভাবছ?

নাদিম… চলে যাওয়া দিনের কথা আর আসছে দিনের পরিণাম; কি হারালাম আর কি পেলাম।

আমি এরকম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটু ভারী করে দিতে পারতাম; যে অবস্থাতে থাকতাম তাকে কাজে লাগিয়ে নিতাম, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি আপনাকে বলছি যখন আমি চকোরীর সংলাপ লিখছি তখন তার প্রযোজক এহতেশাম সাহেব সারাক্ষণ আমার ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওই চলচিত্রের এক জায়গায় এই সংলাপও লিখেছিলাম:

ব্যাপারটা হল স্রোতের বিরুদ্ধে চলা নৌকা কখনও কখনও ডুবেও যায়। ফিরে যাও এই রাস্তায়…’ সংলাপ লেখার পর কিছু কিছু জায়গা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। আমি প্রতিবাদ করে উঠে এসেছিলাম। এরপরও যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছি আমি সাহিত্যের রং ছড়িয়েছি।

সাহিত্য হোক বা চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদীনকে গল্প নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। এ ব্যাপারে তিনি বলেন: সৃষ্টির কাজ খুব কঠিন। অবস্থা আর সমস্যা মিলে গল্প তৈরি হয়। আমি ওইসব চিন্তা এক করে লোকের কাছে তুলে ধরি। যদি আমার মাথায় কোনও কথা ঢুকে যায় এটা লিখতে হবে তো আমি যেখানেই থাকি না কেন লিখে যাই। আমার কোনও কিছু গোছানোর প্রয়োজন পড়ে না। তবে কথাটা হল ব্যস্ততার কারণে লিখতে পারি না।

 

আবু জার মোঃ আককাস। (মার্চ ২০১৮)। ‘উর্দুর বিখ্যাত বাংলাদেশি সাহিত্যিক জয়নুল আবেদীনের কথা’, একজন সাধারণ মানুষের কথা। ব-বর্গীয় প্রকাশন।
করাচি থেকে প্রকাশিত মহিলাদের পাক্ষিক আখবারে খাওয়াতীনের ১৩ই আগস্ট-৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮-র সংখ্যার ২৩–২৪ পৃষ্ঠায় ছাপানো জয়নুল আবেদীনের সাক্ষাৎকারের উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হুমায়রা আতহার আর ছবি তুলেছিলেন শামসুল বেনজামিন মিসী।

 

Rev.: vii·xi·mmxxii