⟪ অনুবাদ ⟫ | «Magazine» | «Home» | «Map&Rev» |
সেইরাতে প্রচণ্ড বাতাসে ডালিম গাছটার সব ক’টা পাতা ঝরে পড়েছে। পাতাগুলো গাছটার গোড়ার চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। একটা বৃত্তের আকারে।
ভোরে গাছটিকে পাতাবিহীন দেখে কিমিকো অবাক হল; আরও অবাক হল নিচে পাতার নিখুঁত একটা বৃত্ত দেখে। তার মানে হল বাতাসে বৃত্তটি কেন ভেঙে যায় নি।
গাছটিতে একটি ডালিম ছিল — খুব সুন্দর সেই ডালিমটি।
সে তার মাকে ডাকল, “মা, একটু এসো ; দেখে যাও।”
তার মা মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ভুলে গিযেছিলাম,” এবং রান্নাঘরে ফিরে গেল।
কিমিকোর মনে হল তারা কত একা। বারান্দার ওপর গাছের সেই ডালিমটিকেও নিঃসঙ্গ মনে হল। ডালিমটাকে কারো মনে নেই।
দু’সপ্তাহের মত আগে তার সাত বছর বয়সের ভাইপো এসেছিল; সঙ্গে সঙ্গেই সে খেয়াল করেছিল ডালিমগুলোকে। সে গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছিল। কিমিকোর মনে হযেছিল যেন সে জীবনের মাঝে দাঁড়িযে আছে।
বারান্দা থেকে সে চেঁচিযে বলেছিল, “ওই ওপরে একটা বড় ডালিম।”
“কিন্তু ওটা পাড়তে গেলে তো আমি নামতে পারব না।”
তা সত্যি, দুই হাতে ডালিম নিয়ে নিচে নেমে আসা সহজ হবে না। কিমিকো হাসল। ছেলেটি বেশ প্রিয় ছিক তার।
যতক্ষণ সে আসে নি, বাড়ির লোকের কেউ-ই ডালিমটা খেয়াল করে নি। এবং তারা সবাই ওটাকে আবার ভুলে গেল।
তখন ডালিমটি ছিল পাতায় ঢাকা; এখন একাই সে আকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।
ডালিমটার মধ্যে এবং গোড়ায় বৃত্তের আকারে ছড়ানো সেই পাতাগুলোয় কেমন একটা তেজের ভাব।
কিমিকো একটা বাঁশের লগি দিয়ে ডালিমটা পেড়ে আনল।
এটা এতই পাকা যে মনে হলো দানাগুলো যেন ফেটে বেরোবে। বারান্দায় রাখার পর রোদে দানাগুলো চক্ চক্ করতে লাগল; মনে হল সূর্যরশ্মি যেন এর ভেতরে প্রবেশ করছে।
নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হলো কিমিকোর।
দশটায় ওপর তলায় বসে সেলাই নিয়ে বসার সময় সে কেইকিচির গলা শুনতে পেল। দরজা যদিও খোলা ছিল, তার মনে হলো কেইকিচি যেন বাগান ঘুরে ভিতরে এল। কণ্ঠে তার জরুরী ভাব।
মা ডেকে উঠল, “কিমিকো, কিমিকো, কেইকিচি এসেছে।” কিমিকো সুতো বের করে সুঁচটা পিন কুশনে বিঁধিযে রাখল।
“কিমিকো অনেক করে বলছিল যাওয়ার আগে সে তোমাকে আবার দেখতে চায়।”
কেইকিচি যুদ্ধে যাচ্ছিল। “কিন্তু শুধু শুধু তোমাকে তো আর দেখতে যেতে পারি না; আর এদিকে তুমিও আস না। তুমি আজ এসেছো এজন্য তোমায় ধন্যবাদ।”
মা তাকে দুপুরে খেয়ে যাবার জন্য বলল, কিন্তু তার খুব তাড়া ছিল।
“ঠিক আছে অন্তত একটা ডালিম খেয়ে যাও। আমাদের বাড়ির ডালিম এটা।” তারপর মা আবার কিমিকোকে ডাকল।
কেইকিচি চোখে চোখে কিমিকোকে সম্ভাষণ জানাল; মনে হল সে কিমিকোর নেমে আসার জন্য আরো অনেক বেশি সময় অপেক্ষায় কাটাতে পারত। কিমিকো সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
কেইকিচির চোখ দেখে মনে হলো তা হৃদ্যতায় ভরা আর তার হাত থেকে ডালিমটি পড়ে গেল।
তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
নিজের হাসি বুঝতে পেরে কিমিকো লজ্জায় লাল হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল কেইকিচি।
“নিজের যত্ন নিও, কিমিকো।”
“হ্যাঁ, আর তুমিও নিও তোমার।”
ইতিমধ্যেই ছেলেটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মাকে বিদায় জানাচ্ছিল।
কেইকিচি চলে যাবার পরও কিমিকো তাকিয়ে থাকল বাগানের দরজার দিকে।
“সে এমন তাড়ার মধ্যে ছিল,” তার মা বলল, “আর ডালিমটাও বেশ সুন্দর।” কেইকিচি ডালিমটা বারান্দায় রেখে গিয়েছিল।
তার চোখে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পেতেই সে ডালিমটা ভাঙতে শুরু করেছিল আর হঠাৎই পড়ে গিয়েছিল তার হাত থেকে। ডালিমটা সে পুরোপুরি দু’টুকরো করে নি। এর দানাগুলো বেরিয়ে পড়েছিল।
তার মা ডালিমটা রান্নঘরে নিয়ে ধুয়ে কিমিকোকে দিল।
কিমিকো ভ্রূকুটি করে ডালিমটা নিল, তারপর রাঙা হয়ে উঠল আবার। কি এক দ্বিধার ভেতরা ডালিমটা নিল।
ডালিমটা দেখে মনে হল কেইকিচি একদিকো কয়েকটা দানা খেয়েছে।
তার মা তাকিয়ে আছে, ডালিমটা না খেলে মার কাছে আশ্চর্য ঠেকতে পারে। উদাসীনভাবেই সে ডালিমটাতে কামড় দিল; টকে মুখ ভরে গেল তার। বেদনাভরা আনন্দের মিশ্র অনুভুতি নেমে গেল যেন তার গভীরে।
তার মাও দাঁড়িয়েছিল উৎসাহশৃন্য ভঙ্গিতে।
এরপর একটা আয়নার সামনে বসল তার মা; বলল, “দেখ আমার চুলগুলো; কি বিচ্ছিরি এলোমেলো চুলেই না আমি কেইকিচিকে বিদায় জানালাম।”
কিমিকো চুল আঁচড়ানোর শব্দ শুনতে পেল।
মা ধীরে ধীরে বলল, “যখন তোমার বাবা মারা যায়, আমার ভয় হত চুল আঁচড়াতে। চুল আঁচড়ালে ভুলে যেতাম আমি কি করছি। আবার সম্বিত ফিরে পেলে মনে হত তোমার বাবা যেন আমার চুল বাঁধা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে।”
তার মনে হলো কি যেন তাকে টানছে ; সুখে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
মা তাকে ডালিমটা দিয়েছিল কারণ তার মার হয়ত ইচ্ছে ছিল না এটা ফেলে দেয়। শুধু এ কারণেই। মার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল কিছু না ফেলে দেওয়া।
নিজস্ব সুখে একাকী কিমিকো তার মায়ের সামনে লজ্জা পেল।
সে ভাল এর চেয়ে ভাল আর কোনভাবেই সে কেইকিচিকে বিদায় জানাতে পারে না, এখন সে অনেকদিন কেইকিচির প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় কাটাতে পারে, যত দীর্ঘই হোক তা সে অপেক্ষা।
সে তার মায়ের দিকে তাকাল। রোদ এসে পড়ছে কাগজের দরজার ওপর, আর তার থেকে কিছু দূরে মা তার আয়নার সামনে বসে আছে।
কিমিকোর কেমন যেন ভয় হল তার হাঁটুর ওপরের ওই ডালিমটা কামড়াতে।
আবু জার মোঃ আককাস। (জুলাই ১৯৯২)। ‘ডালিম’, চোখ, পথিকৃতি প্রকাশন, ঢাকা। পৃ ৮০–৮২
কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির জ়াকুরো (石榴, The Pommegrenate) নামের গল্পের ইংরাজি থেকে অনুদিত।
Rev.: vii·xi·mmxxii