⟪ থোড় বড়ি খাড়া ⟫ | «Blog» | «Home» | «Map&Rev» |
কয়েকটি ব্লগের পুরনো লেখা পড়তে পড়তে চোখ থেমে গেল একটি লেখায়। কোনও একটি পোস্টের উপর কারও মতামতে লেখা আছে যে টেক্সটবুক বোর্ড ক+ত যুক্তাক্ষরকে উপরে ছোট ক এবং নিচে ছোট ত দিয়ে লিখছে, সাবেকি চেহারায় ত+ত-এ বা মাত্রাযুক্ত ও-এ ক’য়ের কান ঝুলে আছে তেমন করে নয়। এবং তাতেই বোধ করি লেখকের গোসসা। মতামতে প্রশ্ন রাখা আছে টেক্সটবুক বোর্ড যে ‘বানান পালটাচ্ছে’ সে ব্যাপারে কি বোর্ড বাংলা ‘একাডেমী’র সাথে কথা বলেছে? হরফের চেহারা পালটালেই যে বানান পালটায় না সেটা কে কাকে বোঝাবে? আর যে একাডেমি তার নিজের নামের বানান নিজের নিয়মে লিখতে পারে না তার সাথে কথা কওয়ারই বা কি আছে? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্ধি-সন্ধি খুঁজে বের করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা বলেই বাংলা একাডেমিকে ভাষার গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে কেউ বলেনি। অনেকেই যুক্তি দেখায় একাডেমির নামের বানান পালটাতে গেলে অনেক হ্যাপা, আইন তৈরির প্রয়োজন, নতুন করে কাগজপত্র ছাপনোর প্রয়োজন, আরও অনেক কিছু। ইংল্যান্ডের সংসদের বয়স প্রায় আট শ’ বছর এবং সংসদের প্রতিষ্ঠানের সময় ইংরেজিতে তার বানান ছিল parlement যেটা এখনকার ইংরেজিতে parliament; এই পরিবর্তনটা ঘটেছে প্রায় ছয় শ’ বছর আগে। ঐতিহ্য আর আইনের দোহাই দিয়ে ব্যাপারটা কিন্তু আদি বানানে আটকে থাকেনি। আর আইনের কথা? ১৯৮৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এক নির্বাহী আদেশে এক দিনেই রাজধানীর বানান Dacca থেকে Dhaka বানিয়ে দিয়েছিল। অনেকের এখনও বেশ মিছে গর্ব অন্তত বানানটা উচ্চারণ মাফিক হয়েছে। অথচ এই পরিবর্তনটা ইংরেজিভাষীদের মধ্যে কেবল ড্যাকা থেকে ডাকা পর্যন্ত। শেক্সপিয়ারের লেখা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত হলে তারও বানান পালটানো হয়, কিন্তু শব্দ এবং শব্দের মানে ঠিকই থাকে।
আর কেবল ক+ত-এর যুক্তি কেন, টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশে তো বটেই, পশ্চিম বঙ্গেও, অনেক যুক্তাক্ষরই ভেঙ্গে লেখে। ঈ-মার্কা ঙ+গ’র চেহারার চেয়ে একটু ছোট বা পূর্ণ ঙ এবং গায়ে লাগিয়ে গ ঢের বেশি সোজা। অন্তত ছোট ছেলে-মেয়েরা তাই মনে করে। আর সেভাবেই লেখা উচিত। অন্তত সরলতা এবং যুক্তির খাতিরে। যদি প্রভাবের দিক থেকে দেখা হয় তাহলে টেক্সটবুক বোর্ড একাডেমির চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা বছরে হাতে গোনা, আর এ বইগুলো পড়ে অনেক কম লোক। কিন্তু টেক্সটবুক বোর্ড ফি-বছর লাখ লাখ ছেলে-মেয়েকে নতুন সহজ যুক্ত হরফে লেখা শেখাচ্ছে। যারা একাডেমি চালায় বা একাডেমি যাদের চালায় তারা যতই হৈ-চৈ করুক না কেন একটা সময় আসবে যখন যারা এখন মণ্ডহরফ ঙ+গ বোধ্য করে লেখে, ক+ত ভেঙ্গে সহজ করে লেখে তারাই একাডেমি চালাবে বা একাডেমি তাদের চালাবে।
১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১১
উইলিয়াম কেরির অভিধান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু গ্রন্থকেন্দ্রে একটি বই ছিল বেশ অনেক দিন ধরেই। তখন বোধ করি গেল শতকের নব্বই; একানব্বইও হতে পারে। পয়সা জমিয়ে কিনে ফেলার সে কি আনন্দ! উইলিয়াম কেরির বাংলা-ইংরেজি অভিধানের প্রথম খণ্ড, দিল্লির এশিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসেস-এর প্রতিলিপি ছাপ, ইংরেজিতে যাকে facsimile print বলে। বইটির দাম ষোলশ’ টাকা। মলাটের প্রান্ত ছিল কিছুটা ছেঁড়া, আর প্রচ্ছদ মলিন, দুয়েক জায়গায় কিসের যেন দাগ। অন্তত বইটির চেহারা খুব একটা খাপসুরত নয়। পাশে দাঁড়ানো আরেক ছাত্র বইয়ের দাম শুনেই শুষ্ক হাসি, যেন এত দাম দিয়ে এই রকম বাজে বই কেনার কোনও অর্থ হয় না।
উর্দুতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: গেল শতকের নব্বইয়ের প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের বইমেলা। মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো বইয়ের স্তুপ। মাঝে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাঙ্গালা আদব কী তারীখ (بنگلا ادب کى تاريخ), উর্দুতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। বাঁধাই-ভাঙ্গা, সুতো বের-হওয়া, মলাট ছেঁড়া, মলিন প্রথম সংস্করণের (পরে বোধ করি আর কোনও সংস্করণ হয় নি) দশ-পনেরটা কপি। পকেটে শ’ দুয়েক টাকা। বাসায় ফেরার পয়সা বাদ দিয়ে কিনতে পারলেই কেল্লা ফতে। বিক্রেতার প্রশ্ন, ক’টা কিনবেন? সাধারণত মানুষ ক’টা একই বইয়ের কয় কপি কেনে? আর কাউকে দেবার জন্য হলে একটা বেশি। হয়ত। কিন্তু উর্দুতে লেখা বাংলার ইতিহাস! যাই হোক, দাম আট টাকা, ১৯৬০ সালের বইয়ের গায়ের দামের বিশ বা পনের শতাংশ। একটাই। পরে আঠা দিয়ে প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠা জুড়তে হয়েছিল পড়বার জন্য।
শেক্ষপিরের নাটক: তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের শেষের দিক। নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে একটি বই কেনা। নাম শেক্সপিয়ার’স লাস্ট প্লেজ়। দাম পঁচিশ টাকার মত। ঠিক মনে নেই। মলাট পোকায় কাটা, ভেতরের পাতাগুলোও একই রকমের এবং এতখানি যে পড়তে গেলে চোখে চাপ পড়ে। লেখক ই, এম, ডব্লিউ, টিলিয়ার্ড। লন্ডন থেকে চ্যাটো অ্যান্ড উইন্ডাসের ছাপানো, ১৯৫১ সালে। বছর দশেক পরে বইটি আবার বাঁধাতে হয়েছিল। নয়ত নষ্ট হয়ে যেত। বইটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা 'পাসড ফর মুনীর চৌধুরী;' নিচে সই এবং সিলমোহর, সুপারিন্টেন্ডেন্ট, দিনাজপুর জেল। একপাশে সিল সেন্সর্ড অ্যান্ড পাসড, সইয়ের নিচে সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিস, দিনাজপুর, ডি, আই, বি। ভেতরে আখ্যাপত্রে একই রকম সিল এবং সই। পাশে কলমের মোটা দাগে লেখা মুনীর চৌধুরী ১৯৫২। তারও নিচে লেখা, দিনাজপুর জেল জুন, ১৯৫২। মুনীর চৌধুরী সে সময়টাতে দিনাজপুর কারাগারে বন্দি ছিল।
৯ই অক্টোবর ২০০৮
বাংলা ভাষা সংক্রান্ত একটি ব্লগ প্রায় বছর তিনেক এবং খবরের কাগজে সম্পাদক এবং লেখকদের প্রতিদিনের কিছু কিছু ঘটনা নিয়ে সে সংক্রান্ত একটি ব্লগ প্রায় দু’বছর ধরে চালানোর পর বাংলা হরফ নিয়ে একটি ব্লগ খোলার প্রয়োজন পড়ে। আশা ছিল মেটাফন্টে বাংলার একটি হরফের রোজনামচা লেখার; অন্তত ভবিষ্যতে যারা বাংলা হরফ নিয়ে কাজ করবে তাদের কিঞ্চিৎ সুবিধে হবার কথা। সে কাজ থেমে আছে; পেশাগত চাপের কারণে, দৈনন্দিন বিশৃংখলায় এবং এরকম অনেক কিছুর জন্য যার দায়িত্ব প্রধানত এবং প্রথমত আমার। আরও তিনটে ব্লগ ছিল এবং এদের কোনওটাই এগোয় নি খুব বেশি।
লিনক্ষ (রোমান হরফের Linux, বাংলা উচ্চারণে লিনুক্স -- লিনুস থুরভাল্দ্সের নিজের ভাষায়, ই-কারটি হ্রস্ব (যদিও সুয়েডীয় ভাষায় স্বরটি দীর্ঘ) আর উ-কারটি কিঞ্চিৎ অন্যরকম; ইংরেজিতে সাধারণ উচ্চারণ লিনাক্স (দ্বিতীয় স্বরটি হিব্রুর শোয়া’র মত) — লিন্যক্সও লেখা যেতে পারে। তবে ঝোঁকটা প্রথম অক্ষরে। বাংলায় লিনাক্স লেখাটাই দস্তুর। পুরনো বাংলায়, সংস্কৃতের নিয়মে, ক + ষ = ক্ষ, এবং নিয়মটা একটু শিথিল ক’রে Maxmüller মোক্ষমূলর আর Shakespeare শেক্ষপীর। Linux-ও তাই লিনক্ষ।) শিখতে শিখতে হঠাৎ মনে হওয়া যে যা-যা কষ্ট করে ঘেঁটে বের করতে হচ্ছে তা এক জায়গায় লিখে রাখলে আর কারুর সুবিধে হতে পারে। সে থেকেই ‘লিনক্ষের খেরোখাতা’র জন্ম এবং পূর্ণবিকশিত হবার আগেই মৃত্যু। প্রাত্যহিক কাজে সেই লিনাক্সের সমস্যা-সমাধানের কাহিনি এই লিনক্ষের খেরোখাতা।
পেশার কারণে খবরের কাগজে কাজ করতে হলেও অনুরোধ-উপরোধে এবং টঙ্কার বিনিময়ে অনেক সময়ই কিছু অনুবাদ বা তর্জমার কাজ করতে হয়েছে। অনুবাদের কোনও নিয়ম নেই; কিন্তু চিন্তা করবার অনেক অবকাশ আছে। সেকারণে আরও একটি ব্লগের জন্ম হয়েছিল: ‘রোজনামা-এ-তর্জুমা‘। রোজনামা (روز نامه) শব্দটি রোজনামচা (روزنامچه)-র প্রকারভেদ; আলাদাভাবে বাংলায় এর তেমন একটা প্রচলন নেই। অন্য শব্দের তল্পিবাহক হলেই তাকে আমরা বেশ চিনি: শাহনামা, বাবুরনামা, আকদনামা, তালাকনামা, আমলনামা, মোখতারনামা, ওসিয়তনামা, ওকালাতনামা, ইশতিহারনামা, একরারনামা, হুকুমনামা, হলফনামা, সফরনামা, দাবিনামা, দাখিলনামা, রাজিনামা প্রভৃতি শব্দের সুরত দেখে চিনে নিতে বা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, অন্তত নামা-র অর্থ। বাংলার শিরনামা, যা প্রায়শই শিরোনাম, আসলে নামা-রই জ্ঞাতি, সর-নামা। রোজ তো অনেকদিন থেকেই বাংলার সফরসঙ্গী। এবং এই ব্লগেরও মৃত্যু।
এদিকে গল্পের যেমন বই হয়, আবার বইয়েরও তেমনি গল্প হয়। বিশেষ করে বই সংগ্রহের গল্প, বই পড়ার গল্প এবং বই হারানোর গল্প। তেমনই কিছু গল্প ছিল ‘বইয়ের গল্প’ ব্লগে। শুরুটা ছিল একটি বইয়ে পাওয়া গল্প দিয়ে...
‘দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের একজন সংগ্রাহকের একটি লোকের সঙ্গে আলাপ হবার পর সেই লোকটি নাকি জানালো যে তার বাড়িতে বহু বছর ধরের সযত্নে রাখা একটি বাইবেল অল্পদিন আগে সে ফেলে দিয়েছে। কে এক “গুটেন...কি যেন” সেই বাইবেলটির মুদ্রক। গ্রন্থপ্রেমী ভদ্রলোক আতঙ্কিত হয় বললেন - “গুটেনবার্গ নয়ত! তা হলে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটির একটি কপি ফেলে দিয়েছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে তার আরেকটি কপি নিলামে বিক্রি হয়েছে চল্লিশ লক্ষ মার্কিন ডলারে।” এ-কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না সেই লোকটি। সে বলল — আমার বইটির দাম খুব বেশি হলে দু “ডাইম” (এক ডলারের দশা ভাগের এক ভাগ) হত। কারণ মার্টিন লুথার বলে একজন লোক বইটির পাতায় পাতায় টীকা-টিপ্পনী লিখে নোংরা করে রেখেছে।’
শুধুই একটি গল্প। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রকাশিত দীপঙ্কর সেন-এর ‘মুদ্রণচর্চা’ থেকে নেওয়া। এদিকে হঠাৎই মনে হল বিষয় নির্দিষ্ট করে ব্লগ লেখার হ্যাপা অনেক। অনেক ভাল সব ব্লগকে এক করে দেওয়া। বাংলা ভাষা’র ব্লগটা থেকে গেল; সাথে থেকে গেল Notes from Newsroom এবং Bangla Haraph ব্লগ দু’টো। বাকিগুলো এক ক’রে এই নতুন ব্লগ।
থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়; তিনটি শব্দ এবং আবার সেই তিনটি শব্দ, উলটো দিক থেকে। কিন্তু মানে কি? যা তাই-ই। এদিক থেকে আর ওদিক থেকে। চোখে পালটানোর স্বপ্ন দেখায় কিন্তু আদতে পরিবর্তন আনে না। জিভে নতুন স্বাদের স্বপ্ন দেখায় কিন্তু স্বাদ পালটায় না। অর্থাৎ যা আছে তাই-ই। আমাদের যাপিত জীবন। পালটানোর আভাসের মাঝে আবার সেই পুরনোর গন্ধ। ফরাসিদের চোখে ব্যাপারটা বোধ করি বেশ ভাল ধরা পড়েছিল: plus ça change, plus c’est la même chose. জিনিস পালটায়, তবে আদতে পালটায় না। আরেকটি অর্থও কিন্তু আছে। খাড়া, বড়ি আর থোড় তিনটিই অকিঞ্চিৎকর, নগন্য, প্রায় মূল্যহীন। মানুষের যাপনও তাই। সেই একই তালিকা থেকে মাঝেমাঝে দু-একটির আগাপিছু আর জীবনে কোনও কিছুরই তেমন দাম নেই। অনেক দামি কোনও কিছুর মুহূর্তের নগন্য কিছুর শর্তসাপেক্ষে অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ে। একেই ইংরেজিতে কি hackneyed mundanity বলে?
২৩শে জানয়ারি ২০০৮
Rev.: vii·xi·mmxxii